মল্লিকা

মল্লিকা
-রুনু ভট্টাচার্য

 

প্রতি সপ্তাহে একবার করে দেখা হয় মল্লিকা দেবীর। বছর 65 বয়স হবে, প্রতি শনিবার একবার করে এই বৃদ্ধাশ্রমেই ছেলের সাথে দেখা হচ্ছে প্রায় এক বছরের উপর। এখানে অনেক মানুষ তার মতো । কেউ বয়সে একটু বড় কেউ ছোট, তবুও তার মন মানতে চায় না । ছেলেকে মানুষ করার কোথাও কি ভুল ছিল? যে এত শিক্ষিত ছেলে সে নিজের কেরিয়ার নিজের ফেমেলি, স্টেটাস এগুলোকে মায়ের থেকে বড় করে দেখলো? মন মানতে চায় না একবার হিসেব টা মিলিয়ে নিতে মন চায়।
প্রতি শনিবারের মতো এই শনিবার ও এসেছে অনুব্রত। এসে রুটিন প্রশ্ন -কেমন আছো মা? ওষুধগুলো ঠিক সময় মত খাচ্ছ তো? পায়ের ব্যাথাটা বাড়েনি তো? নিজের কর্তব্য মতো সমস্ত কাজ শেষ করে ঠিক যখন ফেরার পালা, তখনই বলে উঠলেন মল্লিক দেবী-আজ যদি কিছুক্ষন বেশি থাকো তোমার কাজের কি অনেক ক্ষতি হবে বাবা?
নিজের ঘড়ির দিকে একনজরে দেখে অনুব্রত বলল -না না ক্ষতি হবে কেন?  কিছু কি বলবে মা?
-আচ্ছা তুমি আমায় মিস কর না? আমার কথা মনে পড়ে না একবারও?
উওরটা যেন বহুবছরের অপেক্ষায় ছিল, এক সেকেন্ডও দেরি হয়নি আসতে -“করে মা, তবে ছোটবেলার মতো না। যখন তোমার কাছে শোব বলে বায়না করতাম আর তুমি আমায় একা ঘরে ঘুম পারিয়ে আসতে তখন অনেকটা বেশি করতাম, রাতে বাথরুম যেতে পারতাম না জানো মা ভয় করতো। ঠাকুমার কাছেও শুতে দিতে না , বলতে যে ওনার আজগুবি গল্পেই নাকি আমার এইসব ভয়! এই নিয়ে কম ঝামেলা করেছ ঠাকুমার সাথে? ”
উওরটা শেষ হওয়ার পর অনেক্ষণ শুধু সিলিং ফ্যানেটা কিছু বলছিল, কেউ যদিও খেয়াল করেনি। কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর মল্লিকাই বললেন -আর তোমার উন্নতি, এগুলোর জন্য আমি কিচ্ছু করিনি?
-‘একি বলছো মা? তুমি ছাড়া আমি এই জায়গায় কোনোদিন পৌঁছতে পারতাম? এই যে প্রতি শনিবার আমি আসি এক মিনিট ও লেট করিনি মা, এটা তোমারই শেখানো মা
Punctuality maintain করতে শেখ, এমনকি ঠাকুমার খুব শরীর খারাপ সেদিন ও তুমি আমায় বলেছিলে এটা নিয়ে ভাবতে হবে না math Class যাও late হয়ে যাচ্ছ, এসে শুনেছিলাম ঠাকুমা মারা গ্যাছেন, that day I was late, that day math becomes important that relationship, আর এই দ্যাখো আমার English বলা সেটাওতো তোমার শেখানো, আমি বাংলা গান গাইলেও তুমি বকতে, বলতে” always use English, even if u want to sing”

-কিন্তু সেটা তো তোমার স্বপ্ন সফল করার জন্য!
-স্বপ্ন? মনে আছে মা পড়া না করে আঁকছিলাম বলে আমার সব আঁকার খাতা তুমি কাগজওলাকে বিক্রি করে দিয়েছিলে? সেদিন অনেক স্বপ্নরা ওই কাগজের সাথে বিক্রি হয়ে গেছিল, আসলে তুমি রেজাল্টের কাগজ গুলোকে গুছিয়ে রাখতে তাই আঁকার কাগজগুলোর কোন দাম ছিলনা তোমার কাছে। তারপর দ্যাখো কোনদিকে মন দেইনি, কারুর দিকে ঘুরে তাকাই নি শুধু career….. কান্না টা এবার গলার কাছে ধাক্কা দিতে শুরু করেছে মল্লিকার ।
-এত রাগ তোমার আমার ওপর? তাই বুঝি আমায় বৃদ্ধাশ্রমে পাঠালে?

-না মা আসলে আমার বউ ও শুভকে অনেকটা তোমার মতো করে মানুষ করছে নতুন মেশিন, তাই আমি চাই না তোমার কোন guilty feeling ওকে দেখে আসুক মা, আর আমায় দেখে তুমি খুশি হও না মা? আমি তো তোমার ই projection তোমার স্বপ্ন, emotionless careerist ই তো বানাতে চেয়েছিলে মা?! এই গুলো নিয়ে ভেবো না মা, আজ আসি? পরের দিন না হয় শুভকে নিয়ে আসবো, আর জানো মা শুভ ও খুব ভালো আঁকে, তাই আমি কি করি জানো তো? ওর একটা করে খাতা শেষ হয়ে গেলেই লুকিয়ে রাখি, যাতে ওর ও স্বপ্নটা হারিয়ে না যায়।
ছেলে চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ বাইরের চেয়ারটায় বসে ছিলেন মল্লিকা, মাথায় একটা কথা বারবার ঘুরছে- আমি আর কোন দিন আঁকবো না মা খাতাগুলো বিক্রি করে দিও না ‘
সেদিন খুব রাগ হয়েছিল মল্লিকার, সেদিন রেগে বলেছিলেন একটা কথা, কথাটা আজ বিড়বিড় করে নিজের মনে মনে বলে উঠলেন -‘এটাই তোমার শাস্তি ‘

Loading

Leave A Comment